ডায়াবেটিস কেন হয়ঃ যখন আমরা কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার ( চিনি, ভাত, আলু, রুটি, বিস্কুট, মুড়ি) খাই, তখন তা পেটে গিয়ে ভেঙে গ্লুকোজে (সুগার) পরিণত হয় এবং এই গ্লুকোজ বা সুগার রক্তের মধ্যে চলে যায়। ইনসুলিন হচ্ছে একধরনের হরমোন। ইনসুলিনের কাজ হলো রক্ত থেকে গ্লুকোজকে মানুষের দেহের প্রতিটি কোষে পৌঁছে দেওয়া। সুতরাং যখন এই গ্লুকোজ শরীরের কোষে পৌঁছাবে না বা কোষে ঢুকতে পারবে না , তখন স্বাভাবিকভাবেই রক্তে সুগার বা গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় , তখনি আমরা একে ডায়াবেটিস বলি। সাধারণত প্রসাবের মাধ্যমে কিছু গ্লুকোজ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এই কারণে ডায়াবেটিস রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। যখন প্রস্রাব বেশি হয়, তখন ডায়াবেটিসে ভোগা রোগী তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। দুটি কারনে রক্ত থেকে গ্লুকোজ (সুগার) কোষে পৌছায় না। প্রথমতঃ সাধারন ভাষায় বলা যায় চর্বি বা বিষাক্ত পদার্থের কারনে কোষগুলি Over loaded (ভরা) থাকে, ফলে কোষে জায়গা না থাকার কারনে সুগার বা গ্লুকোজ ঢুকতে পারেনা । অর্থাৎ ইনসুলিন রক্ত থেকে সুগার নিয়ে কোষে সরবরাহ করতে পারেনা কারন কোষে জায়গা নাই। যার ফলে রক্তে সুগার বেড়ে যায়। এই ধরনের ডায়াবেটিসকে আমরা টাইপ ২ ডায়াবেটিস বলি। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীদের অধিকাংশই( প্রায় ৯০%) টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আপনি চাইলেই এই টাইপ ২ ডায়াবেটিস শরীর থেকে পুরোপুরি নির্মুল করতে পারেন। সেক্ষেত্রে দরকার একটি ভালো লাইফ স্টাইল ফলো করা এবং সচেতন থাকা। এক্ষেত্রে আপনাকে নিয়মগুলি মানতে হবে- **১। প্রথমেই ভাত, রুটি , আলু, বিস্কুট, চিনি, মুড়ী অর্থাৎ শর্করা জাতীয় খাবার যতটা সম্ভব কম খেতে হবে তাহলে রক্তে নতুন করে সুগার বাড়বে না। শাকসবজির মধ্যেও কার্বোহাইড্রেট থাকে , সুতরাং কার্বোহাইড্রেট এর ঘাটতি ফ্রেশ শাকসবজি খেয়ে পূরন করতে হবে। অবশ্যই আলু, বিস্কুট, চিনি, চানাচুর, মুড়ী, খই এগুলি খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে এবং এর পরিবর্তে অবশ্যই শাকসবজি খেতে হবে প্রচুর। তবে ব্রাউন চালের ভাত (সাদা ভাতের পরিবর্তে ঢেকি ছাটা চাল বা নিজেদের তত্ত্বাবধানে ধান থেকে পাওয়া চালের ভাত ) অথবা গমের ব্রাউন আটার রুটি সামান্য পরিমান গ্রহণ করতে হবে। অবশ্যই রাতের খাবার ৭ – ৭:৩০ এর মধ্যে শেষ করতে হবে। **২। বিষে ভরা কোষকে খালি করা - এই নিয়মটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ন । নিয়মটি হল- প্রত্যেক দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামায আদায় করে একদম ১০০% খালি পেটে ( অর্থাৎ পানিও খাওয়া যাবেনা ) মিনিমাম ৪৫-৬০ মিনিট দ্রুত গতিতে হাটার মাধ্যমে আপনি আপনার বিষে ভরা কোষকে বিষমুক্ত করতে পারেন , প্রতিদিন সকালে ব্যায়াম করে এসে এক গ্লাস পানিতে পরিমান অনুযায়ী লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন এবং একই সাথে সপ্তাহে একটি কিংবা দুটি রোযা রাখতে হবে আপনার বিষে ভরা কোষকে পরিপূর্নভাবে বিষমুক্ত করতে। কোষ ভরা থাকলে insulin resistance এর উদ্ভব হয় এবং এটিই হল সব রোগের মূল রোগ , তাই insulin resistance আছে কিনা তা দেখতে HOMA-IR test করানো উচিত। **৩। রাত ৯-১০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হবে অর্থাৎ দৈনিক রাতে একটানা ৭-৮ ঘন্টা ডিস্ট্রাবহীনভাবে ঘুমাতেই হবে। ঘুমের কারনে শরীরের কোষ সতেজ হয়, হার্ট ভালো থাকে, মাসল বাড়ে, মানসিক চাপ কমে এবং ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে নামায আদায় করতে হবে। ভোরের বাতাস শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ভালো ঘুম ইনফ্লামেশন কমায় নাটকীয়ভাবে, সুতরাং ভালো ঘুমের বিকল্প নেই। **৪। অবশ্যই শরীর সুস্থ রাখার জন্য এবং শক্তির জন্য ভাল প্রোটিন জাতীয় খাবার ও ভালো ফ্যাট – যেমন, দেশীয় ডিম , টক দই, মাছ, দেশীয় মুরগী, দেশীয় গরুর মাংস ও ভালো ফ্যাট First cold pressed organic olive oil এবং first cold pressed organic coconut oil , বাদাম, খাটি মাখন, খাটি ঘী পরিমিত হারে খেতে হবে। ভাত, রুটি , আলু, বিস্কুট, চিনি অর্থাৎ শর্করা জাতীয় খাবার যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো এবং অবশ্যই এই ভাল প্রোটিন ও ভালো ফ্যাট জাতীয় খাবার খেতেই হবে। তাহলেই দেখবেন ডায়াবেটিস থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। **৫। দিনে খুব অল্প অল্প করে মোট ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। একত্রে বেশি পানি খাওয়া যাওয়া যাবেনা। **৬। প্রচুর ভিটামিন সি (C) সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যা রক্তে উচ্চ গ্লুকোজের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। **৭। অবশ্যই ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে এবং ভিটামিন-ডি এর জন্য উন্মুক্ত শরীরে নিয়মিত রোদ লাগাতেই হবে । **৮। অবশ্যই ধুমপান এবং অ্যালকোহল পরিত্যাগ করতে হবে। **৯। অবশ্যই বাজে তেল খাওয়া যাবেনা । রান্নার জন্য অবশ্যই নিজ উদ্যোগে ভাঙ্গানো সরিষার তেল খেতে হবে অথবা আমাদের অনলাইন শপ ( ultimatestyle.com.bd) এর নিজস্ব কাঠের ঘানিতে ভাঙানো ১০০% নির্ভেজাল এবং কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল ক্রয় করতে পারেন। ** ১০) তারুন্য ধরে রাখার মুল অস্ত্র হল কোলাজেন কিন্তু এই সুগারের কারনেই কোলাজেন সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ বা ধবংস হয়। প্রোটিন যদি সুগার বা কার্বোহাইড্রেট এর সাথে একত্রে খাওয়া হয় তাহলে সাথে সাথে রক্তে সুগার এর মাত্রা প্রচুর বেড়ে যায় ফলে ইনসুলিনও বেশী নির্গত হয় , আর এই ইনসুলিন ফ্যাট রিজার্ভ করে রাখে। তাই ফ্যাট কমানো সম্ভব হয়না। সবথেকে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হল প্রোটিনের সাথে কার্বোহাইড্রেট বা সুগার খেলে রক্তে নাটকীয়ভাবে প্রচন্ড সুগার বেড়ে যায়, এই সুগার স্কিনের কোলাজেনকে প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্থ করে ফলে খুব দ্রুত স্কিন কুচকে যায়। অর্থাৎ প্রোটিন+ কার্বোহাইড্রেট= বুড়িয়ে যাওয়া স্কিন। তাই মাংস বা ডিমের সাথে রুটি কিংবা ভাত খাওয়া যাবেনা, মিস্টি সস দিয়ে মাংস খাওয়া যাবেনা। সালাদ বা ভেজিটেবলের সাথে ডিম বা মাংস খাওয়া উচিত। ১১) যেসব ফলে প্রচন্ড সুগার বাড়ে সেগুলি পরিমিত হারে খেতে হবে । প্রচন্ড সুগার সমৃদ্ধ ফল হল – আনারস, তরমুজ , কলা, খেজুর এবং আম। তবে ফলমূল অবশ্যই যে কোন খাবার খাওয়ার ১ ঘন্টা আগে অথবা ১ ঘন্টা পরে খাওয়া উচিত । যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা এসব ফল যত কম খাবেন ততই ভালো। দ্বিতীয়তঃ আমরা জানি অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নামের হরমোন নিসৃত হয়। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরন বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত থেকে দেহের কোষে গ্লুকোজ বা সুগার পৌঁছাতে পারে না। এতে করে রক্তে সুগার বা গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখনি আমরা একে টাইপ ১ ডায়াবেটিস বলি। টাইপ ১ ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রেও উপরোক্ত নিয়মগুলি ফলো করার পাশাপাশি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডায়াবেটিসের কারণে যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারেঃ রক্তে সুগারের পরিমাণ বেশি হলে রক্তনালীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। সুগারের পরিমাণ বেড়ে রক্তের ঘনত্ব বাড়লে শরীরে রক্ত ঠিক মতো প্রবাহিত হতে পারে না , ফলে যেসব জায়গায় রক্তের প্রয়োজন সেখানে এই রক্ত পৌঁছাতে পারেনা, তখন স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে মানুষ দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারে এবং ইনফেকশনও হতে পারে । রক্তের প্রবাহ অনেক হ্রাস পাওয়ার কারনে যৌন ক্ষমতা খুবই কমে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অন্ধত্ব, কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির পেছনেও একটি বড় কারণ ডায়াবেটিস । যেসব খাবার কখনই খাওয়া উচিত নয়ঃ ঘন দুধের তৈরি কোন খাবার, সাদা ব্রেড, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, বাজারের প্যাকেটজাত ফলের জুস, ক্যান্ডি, চিপস, স্পোর্টস ড্রিঙ্কস, সেরিয়াল, চকলেট, এনার্জি ড্রিঙ্কস, সফট ড্রিঙ্কস, ভাজা পোড়া খাবার, খারাপ তেলে রান্নাকৃত খাবার। ডায়াবেটিস পরিমাপঃ Fasting ( ঘুম থেকে উঠে ১০০ ভাগ খালি পেট থাকা অবস্থায় সুগারের পরিমাণ) ৬.১ এর নিচে থাকলে নরমাল অর্থাৎ ডায়াবেটিস নাই, ৬.১ - ৭ এর মধ্যে থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুকির মধ্যে রয়েছে। এটাকে বলে pre Diabetic, ৭ এর উপরে থাকলে ডায়াবেটিস, এর পর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে ২ ঘন্টা পর টেষ্ট-- ৭.৮ এর নিচে থাকলে নরমাল, ৭.৮ - ১১.১ এর মধ্যে থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুকির মধ্যে রয়েছে। এটাকে বলে pre Diabetic , ১১.১ এর উপরে থাকলে ডায়াবেটিস। ( কিডনী, লিভার , হার্ট বা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের এবং গর্ভাবস্থায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শক্রমে চলতে হবে)
ভালো লাগলো। কতদিন এভাবে চলতে হবে?
ধন্যবাদ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করার জন্য। আশা করি মানুষের উপকার হবে