নারীদের ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এরফলে প্রজনন ক্ষমতা হারানোর নামই মেনোপজ । এটি সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সের মধ্যে ঘটে, তবে কিছু নারীর ক্ষেত্রে এটি তাড়াতাড়ি বা দেরিতে হতে পারে। যদি কোনো নারীর মেনোপজ ৪০ বছর বয়সের আগেই ঘটে, তবে তাকে প্রিম্যাচিউর মেনোপজ বলা হয়। অটোইমিউন রোগ, চিকিৎসাগত কারণ (যেমন, কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন), অথবা সার্জারি (যেমন, ওভারির অপসারণ), জেনেটিক ফ্যাক্টর এর ফলেও প্রিম্যাচিউর মেনোপজ হতে পারে। যদি কোনো নারীর মেনোপজ ৫৫ বছর বয়সের পরেও না ঘটে, তবে তাকে লেট মেনোপজ বলা হয়। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম ও জেনেটিক ফ্যাক্টর এর কারনেও লেট মেনোপজ হতে পারে। যা খুবই ভালো। মেনোপজের সময় নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়, যা বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। “মেনোপজের কারণে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে গেলে সবচেয়ে প্রথমে যেটা ঘটে সেটা হল হটফ্লাস। দিনের মধ্যে কয়েকবার হঠাৎ করে খুব গরম লাগে। মুখ লাল হয়ে যায়, ঘেমে যায়। এছাড়া অনেক কিছু ভুলে যাওয়া, খুব ছোটখাটো বিষয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে ফেলা। যোনিপথ শুকিয়ে যায়, জ্বালা-পোড়া হয়। আর ইস্ট্রোজেন না থাকার আর একটা দীর্ঘমেয়াদি এফেক্ট হল অস্টিওপোরোসিস।”মেনোপজ পরবর্তী সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর একটি হল অস্টিওপোরোসিস । এটি হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ। মেনোপজ পরবর্তী সময়ে নারীরা অস্টিওপোরোসিসের বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। কারন ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতির কারনে হাড়ের ঘনত্ব দ্রুত কমে যায়। এর কোন উপসর্গ থাকে না কিন্তু খুব অল্পতেই হাড় ভেঙে যেতে পারে। নারীর শরীরে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম এবং কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস না থাকলে মেনোপজ পরবর্তী সময়ে অস্টিওপোরোসিস জটিল আকার ধারণ করতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে মেনোপজ নারীদের জন্য অনেক বড় ইস্যু। কারন “তাদের কাছে যৌনতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যৌনতা না থাকলে তারা তাদের জীবনের উপভোগ এবং উদ্যমতা হারিয়ে ফেলেন। তাই তারা সেখানে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করে এবং আরো অনেক কিছু করেন যৌনতা টিকিয়ে রাখার জন্য । তাই অল্প বয়স থেকেই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে মেনোপজ বিলম্বিত করা যেতে পারে এবং মেনোপজের পরেও যৌন আকাঙ্ক্ষা বজায় রাখা যেতে পারে। নিচে বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সুপারিশ দেওয়া হলো: মেনোপজ ঠেকানোর জন্য পদক্ষেপ: স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ক) সয়া, টফু, চিয়া সিড ও ফ্ল্যাক্স সিডে প্রচুর পরিমাণে ফাইটোইস্ট্রোজেন থাকে, যা ইস্ট্রোজেনের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে। খ) আখরোট, আলমন্ড, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্সসিড, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেগুলি যৌন স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়ক। স্বাস্থকর ফ্যাট যেমন অলিভ ওয়েল দিয়ে সালাদ, বীট, রসুন, খাটি ঘী, ডিম, দই, ছানা , পনির, পালং শাক ইত্যদি নিয়মিত খেতে হবে। গ) অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার যেমন গ্রিন টি, ব্রোকোলি, পালং শাক ও অন্যান্য শাকসবজি গ্রহণ করা উচিত। ঘ) ভিটামিন ডি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান যা শরীরের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন ডি না থাকলে শরীর ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারেনা, পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখে, ভিটামিন ডি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ভিটামিন ডি এর অভাবে ডিপ্রেশন দেখা দেয়, ভিটামিন ডি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীর কার্যক্রম সঠিক রাখতে সহায়ক, ভিটামিন ডি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক এবং ভিটামিন ডি ত্বকের কোষের উন্নতি করে ও ক্ষত সারাতে সহায়ক। ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস সূর্যের আলো। নিয়মিত উন্মুক্ত শরীরে সূর্যালোক গ্রহণ শরীরে ভিটামিন ডি উৎপাদনে সহায়ক। তৈলাক্ত মাছ ,ডিমের কুসুম, লিভার খেলেও সামান্য ভিটামিন ডি উতপাদন হয় এছাড়াও ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহন করা যেতে পারে এবং ক্যালসিয়ামের জন্য কাঠ বাদাম, দই, পনির খেতে হবে নিয়মিত। নিয়মিত ব্যায়াম: ক) কার্ডিও ও স্ট্রেংথ ট্রেনিং: দৌড়ানো , সাঁতার কাটা, দ্রুত হাঁটা এসব কার্ডিও ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে , হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় , রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমায়, মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং মুড উন্নত করে এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে। ওয়েট লিফটিং (Weight Lifting), পুশ-আপস (Push-ups), স্কোয়াট (Squats), লাঞ্জেস (Lunges) এসব স্ট্রেংথ ট্রেনিং পেশির ভর ও শক্তি বৃদ্ধি করে, হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমায়, খ) মেডিটেশন ও ডিপ ব্রিদিং: মানসিক চাপ কমাতে এবং মুড উন্নত করতে সাহায্য করে। গ) সুগার ও ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন মেনোপজ ত্বরান্বিত করতে পারে। তাই স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবেই হোক রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রন করতে হবে এবং স্বাস্থকর খাবার গ্রহন ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকার সর্বোচ্চ চেস্টা করতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুম: পর্যাপ্ত এবং নিয়মিত ঘুম শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ , প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম শরীরের হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ঘুমানো উচিত এবং অবশ্যই ভোর রাতে অর্থাৎ ৪:৩০টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া উচিত। শরীর সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ডীপ ঘুমের কোন বিকল্প নেই। মেনোপজ পরবর্তী যৌন আকাঙ্ক্ষা তীব্র করার জন্য পদক্ষেপ: মেনোপজ পরবর্তী সময়েও পূর্বের মত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ভিটামিন , ক্যালসিয়াম ও মিনারেল গ্রহন, নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম ঠিক রাখতে হবে এবং পাশাপাশি নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলিও গ্রহন করতে হবে। হরমোন থেরাপি: এস্ট্রোজেন থেরাপি, টেস্টোস্টেরন থেরাপি (যদি প্রয়োজন হয়) যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হতে পারে। একজন চিকিৎসকের পরামর্শে হরমোন থেরাপি গ্রহণ করা উচিত। PT-141 ইনজেকশনঃ মেনোপজের পরে অনেক নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যেতে পারে। PT-141 এই সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে। এটি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলিকে প্রভাবিত করে, যা যৌন আকাঙ্ক্ষা পুনরুদ্ধারে সহায়ক।PT-141 একটি নন-হরমোনাল ওষুধ, যা হরমোনাল থেরাপির মতো সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। এটি মেনোপজ পরবর্তী মহিলাদের জন্য একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শক্রমে গ্রহন করা যেতে পারে। উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য খাবারঃ ডার্ক চকলেটে ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে, যা রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে। এটি মুড উন্নত করতে সহায়ক। সেক্সের পূর্বে এক-দুই টুকরা ডার্ক চকলেট খেতে পারেন। বাদাম ও বীজে জিঙ্ক থাকে, যা টেস্টোস্টেরন লেভেল বাড়ায় এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করে, মাঝে মাঝে গরুর মাংস খাওয়া যেতে পারে জিংক বাড়ানোর জন্য। ডিমে ভিটামিন বি৬ এবং বি৫ থাকে, যা যৌন হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং স্ট্রেস কমায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে, যা যৌন উত্তেজনা এবং শক্তি বজায় রাখতে সহায়ক। সেক্সের আগে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। গ্রিন টিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং মুড উন্নত করতে সাহায্য করে। ম্যাকা রুট, গিঙ্কো বিলোবা, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সাপ্লিমেন্ট যৌন উত্তেজনা বাড়াতে খাওয়া যেতে পারে। অন্যান্য করনীয়ঃ নিয়মিত যোগ ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। সঙ্গীর সঙ্গে মানসিক সংযোগ বজায় রাখা এবং রোমান্টিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা। যৌন আকাঙ্ক্ষা বাড়াতে সঙ্গীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা। যৌন উত্তেজনা এবং আকাঙ্ক্ষা বাড়ানোর জন্য লুব্রিকেন্ট এবং ভাইব্রেটর ব্যবহার করা যেতে পারে যদি ইসলাম ধর্মে অনুমতি থাকে । সর্বোপরি মেনোপজ ঠেকানোর জন্য এবং মেনোপজ পরবর্তী যৌন আকাঙ্ক্ষা বজায় রাখতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মহিলার শরীর ভিন্ন, তাই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নির্দেশনা মেনে চলা সর্বোত্তম।